Sign in
Sign in
Recover your password.
A password will be e-mailed to you.
সম্পাদকীয়
ছুঁয়ে থাকা চাই
বাঙালির মেধা, বুদ্ধি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি তার অনুরাগ ও চর্চা নিজেদের মধ্যে তো বটেই, এই দেশে এবং দেশের বাইরেও আগ্রহের বিষয় হয়ে থেকেছে বহুকাল। রোজকার ডাল-ভাতের জীবনযাপনের ভেতরে, সময়ের অনেক উথালপাথালের ভেতরেও বাঙালি তার ভাবনার পরিসরকে, চিন্তা-চেতনার প্রবাহকে রুদ্ধ করেনি। সেখানেই তার গোত্র আলাদা। শুধু শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিই বা কেন। দর্শনে, বিজ্ঞানে, ইতিহাসে অন্য ও অনন্য চিন্তার দিশারী হতে আটকায়নি তার। এইসব পথের পথিক যাঁরা তাঁদের বাঙালি শ্রদ্ধা করেছে, ভালবেসেছে, মনে রেখেছে। কখনও কখনও যে তাতে টোল খায়নি এমন নয়। মরচেও পড়েছে। যদিও তাতে করে ধারাটি যে এখনও বহমান সেকথা অস্বীকার করা যায় না। গড় বাঙালির সবাই যে এই ধারারই শরিক এমন কোনও দাবি নেই। তা হওয়া সম্ভবও নয়। পৃথিবীর অন্য কোনওখানেও এমনটা হয় বলে সাক্ষ্য নেই। তবে বাঙালির যে এক বিশেষ পরিচয় গড়ে উঠেছে মননের অগ্রাধিকারে সেকথাই বা ভোলা যাবে কী করে। সেক্ষেত্রেও সবাই যে বিশিষ্ট হয়ে উঠবেন এমনটা নয়। যাঁরা হয়ে ওঠেন তাঁদের আমরা আরও অনেকের প্রতিনিধির চেহারায় দেখে থাকি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বেশিরভাগ মানুষ অভিনেতা হিসেবেই চেনেন। বিশেষ করে সিনেমায় তাঁর অভিনয়ের কারণেই চেনেন। সেটাই স্বাভাবিক। যাঁরা তাঁকে নাটকে পেয়েছেন তাঁরাও অভিনেতাকেই পেয়েছেন। সেই তাঁর অন্যতম পরিচয়। সিনেমায় তিনি এমনভাবে উপস্থিত ছিলেন যাতে বলা যায়, বাংলা সিনেমার পাশাপাশি চলতে থাকা দুটি ধারাতেই তিনি নিজেকে প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছিলেন। একজন অভিনেতার এমন গুণ বড় সহজ নয়। এমনটা পেরেছিলেন কীভাবে। এক তো অবশ্যই তাঁর অভিনয়ের ক্ষমতা, দ্বিতীয়ত অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গেই মননের চর্চা, যা মিশে গিয়েছিল সেই অভিনয়েই। তিনি কবিতা লিখেছেন, গদ্য লিখেছেন, ‘এক্ষণ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন নির্মাল্য আচার্যর সঙ্গে, নানা বিষয় আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন নিরন্তর, ছবি এঁকেছেন, গান গেয়েছেন। আবৃত্তিতেও ছিল বুদ্ধি ও আবেগের সমান উপস্থিতি। খেয়াল করলেই দেখা যাবে, অভিনয় ছাড়া তিনি আর যা কিছু করেছেন তার অনেকটাই বহু শিক্ষিত বাঙালি তাঁদের জীবনের কোনও না কোনও না সময়ে চেষ্টা করেছেন, রপ্ত করেছেন। ফলে সব মিলিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বুদ্ধিদীপ্ত, সচেতন, সংবেদনশীল বাঙালির অবয়ব হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মৃত্যু তাই একসঙ্গে অনেক দীর্ঘশ্বাসের কারণ।
আমাদের এক বিশেষ মনখারাপ জুড়ে রয়েছে তাঁর চলে যাওয়ায়। 'সুখপাঠ' পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় জুলাই মাসে। চার তারিখ তার একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও হয়েছিল। সেখানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি এসেছিলেন কথা দিয়েছিলেন বলে। অনলাইনে পড়ার ব্যাপারে নিজে স্বচ্ছন্দ নন, একথা বলার পরেও নতুন এই মাধ্যমটিকে স্বাগত জানাতে কোনও কুণ্ঠা ছিল না তাঁর কণ্ঠে। সেদিন আরও একটি প্রাপ্তি ঘটেছিল আমাদের। জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ থেকে আবৃত্তি করেছিলেন তিনি। এখনও তা আমাদের স্মৃতিধার্য হয়ে আছে। 'সুখপাঠ' শুরুর দিনটির সঙ্গে তাঁর এই যোগাযোগ মুছে যাওয়ার নয়।
এই সময়েই চলে গিয়েছেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। দীর্ঘদিন তিনি প্রবাসে ছিলেন। তাতে যদিও বাংলা কবিতায় তাঁর উপস্থিতি এতটুকু ম্লান হয়নি। তাঁর অনুনকরণীয় কাব্যভাষা সমসাময়িকদের থেকে স্বতন্ত্র ছিল, যা স্থিত থেকেছে পরবর্তী সময়েও। প্রেম, নিঃসঙ্গতা, প্রকৃতি ও শহরের বীক্ষণ তাঁর কবিতায় যে অনুভব এবং দর্শন নির্মাণ করে তার উপলব্ধি কবিতার দীক্ষিত পাঠকমাত্রেই জানেন। ছন্দ ভেঙেছেন, ছন্দ গড়েছেন, তৈরি করেছেন অভূতপূর্ব অমোঘ শব্দাবলি। গদ্যেও ভাষার নির্মাণ এবং শিল্প ও জীবনের রহস্য উন্মোচনে তিনি স্বভাব-স্বতন্ত্র। ফরাসি ও জার্মান ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন, বাংলা থেকেও অন্য ভাষায় করেছেন অনেক। বাংলা ভাষায় লেখালেখির যাঁরা মনস্ক পাঠক তাঁদের মন তো ভার হয়ে আসবেই এমন এক কবির নিষ্ক্রমণে।
তবে মনে রাখার কথা এটাই যে, মনখারাপ হতে পারে কিন্তু তাতে আমরা নিঃস্ব হয়ে যাইনি। আলোর স্বভাবই এই যে তা আলোকিত করে। যা কিছু ভাল তা তো আলোরই মতো। এক একজন মানুষের উপস্থিতি, সৃষ্টি সময়ের পরতে পরতে রয়ে যায়। হারায় না। ধুলো পড়লেও তা মুছে নিয়ে আয়না করতে হয়। ঐতিহ্যের অনেক প্রকার। তাকে ছুঁয়ে থাকা চাই।
অরিন্দম বসু, সম্পাদক