Sign in
Sign in
Recover your password.
A password will be e-mailed to you.
সম্পাদকীয়
প্রতিষেধক
সেই গেলাসের গল্পটা অনেকের জানা আছে নিশ্চয়ই। যে গেলাসে আধাআধি জল রাখা থাকে। তার সঙ্গে রাখা থাকে একটি প্রশ্নও। গেলাসটা অর্ধেক ভর্তি না কি অর্ধেক খালি? উত্তরে কেউ বলেন আধা খালি, কেউ বলেন আধা ভর্তি। উত্তর থেকে বোঝা যেতে পারে জীবনকে একজন কীভাবে দেখেন। যিনি অর্ধেক ভতি দেখেন তিনি আশাবাদী। যিনি দেখেন অর্ধেক খালি তার দৃষ্টি নিরাশার।
বছর ঘুরে এল। পৃথিবী নামের এই গ্রহের বয়স বাড়ল। মানুষেরও। নতুন ইংরেজি বছরের হিসেবে অবশ্যই। এটাই চালু হিসেব। সে যাইহোক, আসলে তো হিসেব জীবনের।
নতুন বছরে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা নিশ্চয়ই একটি অসুখের বিদায়। যে অসুখ গেল বছরের শুরু থেকেই আমাদের ভয় দেখিয়ে চলেছে সারা পৃথিবী জুড়ে। হাত-পা বেঁধে ফেলেছে। নড়েচড়ে বসারও উপায় নেই তেমন। অসুখে প্রাণ গিয়েছে অনেকের। সামাজিক জীবনে, আর্থিক ব্যবস্থায় গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে। তার নিরাময় সহজসাধ্য নয় এবং তার প্রভাব যে কত দূর ছড়িয়ে থাকবে সে আন্দাজও করা যাচ্ছে না।
মুশকিল হচ্ছে এই যে, আমাদের স্বভাব কাছাখোলা ধরনের। নিয়ম মানতে বড়ই অনীহা। সেটা যে শুধু এই অসুখকে ঘিরে তা নয়। অনেক আগে থেকেই তা আমাদের অভ্যেসে ঢুকে বসে আছে। অসুখ আসার পরে ভাবখানা এমন যে, ও অন্যদের হবে, আমার কিছু হবে না। আমার পরিবারটি অক্ষত থাকবে। কাজেই অন্যের দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। সত্যি বলতে কী, এই অসুখ আমাদের আরও বেশি করে দেখিয়ে দিয়েছে যে আমরা পরস্পরের প্রতি অবহেলা রাখি। তা বেড়েছে বই কমেনি। সেও তো অসুখ। ভাইরাস। গভীরতর হয়ে তা বহুকাল চেপে বসে রয়েছে আমাদের মনে। তার প্রতিষেধক নেই। তাহলে ঠিক কোন আশায় বাঁচতে চাইছি আমরা?
ইতিমধ্যে এমন একটি কথা শোনা যাচ্ছে, এই অসুখে আগের পৃথিবী যেমন ছিল তেমন আর থাকবে না। অনেক বদলে যাবে। বদলটি ঠিক কেমন হবে সে বিষয়ে যদিও কিছু শোনা যাচ্ছে না। তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে বলেও তো মনে হচ্ছে না। অসংখ্য মানুষের কাজ হারানোয়, অভিবাসী শ্রমিকদের বিপন্নতায়, চিকিৎসা জগতে যারা যুক্ত তাদের মৃত্যুতে, পরিবেশের বদলেও বদলেছে কি কিছু? এই অসুখে কি আমরা কোনও অতিরিক্ত সচেতনতা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি? না কি এ শুধু বাধ্য হয়ে সময়ের অপেক্ষা, যে অপেক্ষা উতরে যেতে পারলে আমরা যেমন আছি তেমনই থাকতে পারব। প্রতিষেধক এসে রোগটিকে ঠেকিয়ে দিতে পারলেই হবে। আশা বলতে মনে বাসা বেঁধে রয়েছে তেমনই কিছু। মাঝখানে থেকে যাবে উথালপাথাল হয়ে যাওয়া কিছুটা সময়।
পৃথিবীতে এর আগে কোনও মহামারি আসেনি এমনটা নয়। মানুষই তার বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি দিয়ে তাকে রুখেছে। প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে। এবার একটি তফাত অবশ্য রয়েছে। অন্য মহামারি নির্দিষ্ট কোনও দেশে বা একসঙ্গে কয়েকটি দেশে ছড়ালেও গোটা পৃথিবীতে সে দাপিয়ে বেড়ায়নি। এখানে বিপন্নতার বিস্তার বিপুল। এ বিশ্ব প্রাণের বাসযোগ্য থাকুক, এমন আশায় যদি বুক বাঁধতে হয় তাহলে তার বিস্তারও বিরাট হওয়া চাই।
নতুন বছর যেমন আসার কথা ছিল তেমনই এসেছে। তার অর্ধেক ভর্তি না অর্ধেক খালি তা আমরা এখনও জানি না। তবে ওই গেলাসের গল্পটি সত্যি। জীবনপাত্র উছলে না পড়ুক, অর্ধেক ভর্তি হলেও চলে। কারণ মানুষ আশায় বাঁচে, বাঁচতে চায়। ভালবাসা থাকলে বাঁচা যায়। সেও এক বড় প্রতিষেধক।
এই সময়ের মধ্যে সাহিত্যে এসব কথা এসেছে। আরও আসবে কারণ তা তো সময়েরই ফসল। তা জীবনকে দেখতে চায়, দেখাতে চায়। সময়ের এক কঠিন বাধা মানুষ কীভাবে অতিক্রম করতে পারে, সাহিত্য তার সাক্ষী থাকবেই।
অরিন্দম বসু, সম্পাদক